কোনো জাতির উন্নতির প্রধান স্তর হচ্ছে শিক্ষা। আর এ শিক্ষার প্রথম স্তর হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা। কোনো জাতির শিক্ষার প্রাথমিক স্তর যদি বাধাগ্রস্ত হয় তাহলে সে জাতি উন্নতি করতে পারে না। তাই শিক্ষা ছাড়া জাতির উন্নতি যে সম্ভব নয়, তা অনুধাবন করেছিলেন বাঙালি জাতির পিতা ও বাংলার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি একটি শিক্ষিত জাতির স্বপ্ন দেখেছিলেন। তিনি অনুভব করতে পেরেছিলেন দেশের উন্নয়নের জন্য, দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য, সাধারণ মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো শিক্ষা, বিশেষ করে প্রাথমিক শিক্ষা। প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়ন ছাড়া জাতীয় শিক্ষার ভিত মজবুত করা অসম্ভব। তাই বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তারের জন্য পাকিস্তান আমল থেকেই পাকিস্তান সরকারকে বিভিন্ন প্রস্তাবনা দিয়ে আসছিলেন।
১৯৭০ সালের নির্বাচনের সময় টেলিভিশনে দেওয়া এক ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন সুষ্ঠু সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য শিক্ষা খাতে পুঁজি বিনিয়োগের চেয়ে উৎকৃষ্ট বিনিয়োগ আর কিছু হতে পারে না। নিরক্ষরতা অবশ্যই দূর করতে হবে- পাঁচ বছর বয়স্ক শিশুদের বাধ্যতামূলক অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষাদানের জন্য একটি ক্র্যাশ প্রোগ্রাম চালু করতে হবে। দরিদ্রতা যেন উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে মেধাবীদের জন্য বাধা হয়ে না দাঁড়ায়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। তারই ধারাবাহিকতায় দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে প্রায় ৩৭ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ, ১ লাখ ৫৭ হাজার ৭২৪ জন শিক্ষককে সরকারীকরণ, ১১ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন, ৪৪ হাজার শিক্ষক নিয়োগ ও চাকরি সরকারীকরণ, ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের বিনা মূল্যে বই ও গরিব মেধাবী শিক্ষার্থীদের পোশাক দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। যার ফলে প্রাথমিক শিক্ষার অগ্রগতির সোপান রচিত হয়।
এ ছাড়া স্বাধীন দেশে প্রথম বাজেটে শিক্ষা খাতে ৭ শতাংশ বরাদ্দ বেশি রেখেছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৮ সালে সরকার গঠন করার পর ২০১৩ সালের ৯ জানুয়ারি ২৬১৯৩টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণের ঘোষণা করেন। বাবার ধারাবাহিকতাকে অক্ষুণ্ন রেখে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বঞ্চিত শিক্ষদের যথাযোগ্য মর্যাদা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। স্বাধীনতার পর দেশ পরিচালনার জন্য যে সংবিধান প্রণয়ন করেন তাতে বঙ্গবন্ধু শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। সংবিধানের ১৭ নম্বর অনুচ্ছেদে শিক্ষার বিষয়টি উল্লেখ আছে। তাতে রয়েছে ১৭(ক) একই পদ্ধতির গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে সপরিবারে হত্যার পর বিভিন্ন সরকার ক্ষমতায় আসে। তখন প্রাথমিক শিক্ষায় বঙ্গবন্ধুর প্রচেষ্টার কিছুটা বাধাগ্রস্ত হলেও ১৯৯০ সালে প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করার পর থেকে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য এবং শিশুদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানমুখী করার জন্য ১৯৯৩ সাল থেকে খাদ্যবান্ধব শিক্ষা কর্মসূচি চালু করে। প্রতিটি উপজেলার নির্ধারিত কিছু ইউনিয়নের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা এককভাবে ১৫ কেজি ও যৌথভাবে ২০ কেজি করে গম অথবা সমমূল্যের চাল পেত।
প্রাথমিক শিক্ষার জন্য খাদ্য কর্মসূচির প্রকল্পবহির্ভূত ইউনিয়নসমূহের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর জন্য ১৯৯৯-২০০০ অর্থবছরে সরকার প্রাথমিক শিক্ষা উপবৃত্তি প্রকল্প চালু করে। সুবিধাভোগী প্রতিটি শিশুর পরিবারকে মাসে ২০ টাকা হারে দেওয়া হতো। পরবর্তী সময়ে উপবৃত্তির টাকা ২৫ টাকায় উন্নীত করা হয়। ২০০২-২০০৩ অর্থবছরের শুরুতে সরকার শিক্ষার জন্য খাদ্য কর্মসূচি বন্ধ করে মহানগরী ও পৌরসভা এলাকাবহির্র্ভূত সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষার জন্য উপবৃত্তি প্রকল্প চালু করেন। ‘প্রত্যেক একক সুবিধাভোগী পরিবার মাসে ১০০ টাকা এবং যৌথ পরিবারকে মাসে ১২৫ টাকা হারে উপবৃত্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।
বর্তমানে প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ে পড়াশোনা করছেন তাদের প্রতি মাসে ৭৫ টাকা করে উপবৃত্তির টাকা প্রদান করা হয়। তাছাড়া প্রথম শ্রেণী থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত একজন শিক্ষার্থীকে ১৫০ টাকা প্রদান করা হয়। যদি একই পরিবারের দুজন সন্তান এই উপবৃত্তির টাকা পাওয়ার জন্য নির্ধারণ করে থাকে তাহলে দুজন সন্তান প্রতি মাসে ৩০০ টাকা করে উপবৃত্তি পেয়ে থাকে।
২০০২-২০০৩ অর্থবছর থেকে ২০০৬-২০০৭ পর্যন্ত এ প্রকল্পের শুরুতে বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৬০,৬৬৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ৩৩০০টি স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা। মোট সুবিধাভোগী শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৬০,০১,৪৬০ জন। সুবিধাভোগী পরিবার ছিল একক ৫৫,৯৩,৪৫৮টি, যৌথ ১,০১,১৩০টি। পরবর্তী সময় এ সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে । সর্বশেষ ২০২০-২১ সালের হিসাব মতে মন্ত্রণালয়ের এক তথ্য থেকে জানা গেছে, বর্তমানে ৬৫ হাজার ৬২০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ১ কোটি ৭৬ লাখ ৩ হাজার ৮৪৯ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ২০২০-২১ অর্থবছরে বরাদ্দ থাকা ১১৬ কোটি ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা বিতরণ করা হয়েছে, যা বর্তমানে চলমান রয়েছে।
আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩১ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে এই বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ২৬ হাজার ৩১৪ কোটি টাকা।
বর্তমান সরকার প্রাথমিক শিক্ষাকে আরো যুগোপযোগী করার জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গমনেচ্ছু শিক্ষার্থীদের নানামুখী আকর্ষণীয় প্রকল্প গ্রহণ করেছে, যাতে করে কোনো শিক্ষার্থী বিদ্যালয় থেকে অকালে ঝরে না পড়ে। সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও এনজিও এ বিষয়েও নানাভাবে কার্যকর ভূমিকা রাখছে।
সরকারের উপবৃত্তিসহ নানামুখী আকর্ষণীয় কার্যক্রমের ফলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রাঙ্গন আবার চেনা পরিবেশে ফিরে আসতে শুরু করেছে। অভিভাবকদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে।
তাই আমরা বলতে পারি বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা ও বঙ্গবন্ধুর রেখে যাওয়া গণমুখী শিক্ষাব্যবস্থা সে পথ ধরেই হাঁটছে বলে আমার বিশ্বাস। বাংলাদেশের ইতিহাসে যত দিন এই পদ্মা, মেঘনা, যমুনা ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নজরুল, জসীম উদদীনের স্মৃতি সমুন্নত থাকবে এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শ সমুন্নত থাকবে, তত দিন শিক্ষার সাফল্য অনিবার্য আসবেই। আর পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে বাংলাদেশের স